সুমিত্রা সেন
ক্লাস নাইন কি টেন তখন। শুনলাম বেঙ্গল মিউজিক কলেজে উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ আসছেন। সত্যি বলতে, উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব যে কে, সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা ছিল না তখন। একদিন ননীবাবু আমাদের ক্লাসে এলেন। টিচারদের বললেন, খাঁ সাহেব আসা উপলক্ষে অনুষ্ঠান হবে। সেখানে প্রারম্ভিক গান হিসেবে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে। ক্লাস থেকে আমার কথা বলা হয়েছিল। আমার যে খুব সাহস ছিল, তা নয়। তবে এ-ও হতে পারে, পরিস্থিতির গুরুত্ব আমি আঁচ করতে পারিনি তখন। তাই হয়তো রাজি হয়ে যাই। এখন ভাবি, কী ভয়ঙ্কর কাজটাই না তখন করেছিলাম। উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সামনে গান গাওয়া।
এর আগে আমি কখনও মাইক্রোফোনে গান গাইনি। এত লোকের সামনে তো নয়ই। মায়ের কাছে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলাম, ‘মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এ বার মোর করুণ রঙিন পথ।’ খুবই কুন্ঠা নিয়ে গাইলাম। সামনে বসেছিলেন খাঁ সাহেব। শীর্ণকায়। টুপি মাথায়। অনুষ্ঠান হল। সন্ধ্যেয় আমি বাবার সঙ্গে খাঁ সাহেবের গান শুনলাম। কী ভয়ঙ্কর সুন্দর সেই গান। খাদে যখন গলা ফেললেন, তখন যেন মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম।
পরদিন সকালে খাঁ সাহেব স্কুলে এলেন। প্রণাম নেওয়ার পর বললেন, ‘বেটি তুমি কাল গান করছিলে না?’ আমি সলজ্জ ঘাড় নারলাম। উনি বললেন, ‘তোমার গান হবে। তুমি ভালো করে শেখো। তোমার গলাটা খুব মিঠা।’
ফৈয়াজ খানের এই কথা ননীবাবু লুফে নিলেন। পরদিন হাজির হলেন আমাদের বাড়ি। বাবাকে গিয়ে ধরলেন। তারপর বাবাকে রাজি করিয়ে সেতারের বদলে ক্লাসিকাল ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিলেন। প্রথাগতভাবে গান শেখার সেই শুরু। কিছুদিন পরে বুঝতে পারলাম এ তো অথৈ সমুদ্র। আবার, গান শেখার পক্ষে অপরিহার্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম।
আমি বলব, যাঁরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবেন, তাঁদের ক্লাসিকাল না শিখলে হয় না। এ জন্য আমি নিজে বেশ কিছু দিন ননীবাবুর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছি।
এই সময়। ১৭ মে, ২০১৫।