আমাদের ডেস্ক


শান্তনু দে – সম্পাদক

বদলে যাচ্ছে সময়। অস্বাভাবিক দ্রুততায়।

হারিয়ে যেতে বসেছে এই বসুন্ধরার নানা মাটির অপার সংগীতের বৈচিত্র্য। বিশ্বজুড়ে শিকড় ছেঁড়ার শব্দ। সংস্কৃতির ক্লোন। একই ছাঁচে ঢালা সংস্কৃতি। বহুত্বকে দুমড়ে মুচড়ে ‘এক বিশ্ব, এক সংস্কৃতি’র স্লোগান। সংস্কৃতির সমজাতীয়করণ।

মিলে সুর মেরা তুমারা, ফির সুর বানে হামারা— এখন প্রায় অতীত। এখন শুধুই বেসুরো পপ। কিংবা, ঝাঁ চকচকে রেকর্ডিং রুমে বসে চটুল মোড়কে সস্তার রিমিক্স, রিমেক। হারিয়ে যাচ্ছে মৌলিক সৃজন। যেমন কুমিল্লা, ময়মনসিংহের ভাওয়াইয়া চটকা অঙ্গের লোকগান ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁদ’ ঢাকায় এসে হয়ে যায় ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, সেখান থেকে মুম্বাইয়ে, ‘ইয়ার বিনা চ্যান কঁহা রে।’ এভাবেই বাংলার মেঠো লোকগান ধানসিড়িটির তীর থেকে তুলে কংক্রিটের জঙ্গলে শহরস্থ হয়েছে, হচ্ছে। রূপসী বাংলার আদ্র পলিমাটির অনেক গভীর থেকে নষ্ঠ ধমনীর মতো ছিঁড়ে যাচ্ছে আমাদের জন্মের শিকড়।

মাটির গান হচ্ছে ভালগারাইজড। হারিয়ে যাচ্ছে ভুবনভোলানো অনিন্দ্যসুন্দর সুর। সেই জায়গা করে নিচ্ছে উন্মত্ত রিদম। সিন্থেসাইজার, কি-বোর্ডের চড়া ভাইব্রেটারে প্রতিদিন খুন হচ্ছে আঞ্চলিক ঢোল, বঙ্গ’র মতো হরেক কিসিমের বাদ্যযন্ত্র। নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে নির্বাসনে।

একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে রিয়েলিটি শো। আগ্রাসী কর্পোরেট সংস্কৃতি। একটু গান শিখেই নাম কেনার পিঁপড়ে দৌড়। এতে সংস্কৃতির কতটা উন্নতি হচ্ছে বলা শক্ত, তবে প্রতিদিন খুন হচ্ছে নতুন প্রতিভার বিকাশ, সৃজন-দক্ষতা।

সংগীত, শিল্প সংস্কৃতির ধ্রুপদী প্রাণশক্তির সমস্ত ধমনীতে শুধু কুঠারাঘাতের শব্দ। সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতার ঐতিহ্য পরস্পরাকে ভাঙা হচ্ছে নির্বিকার নির্দয়তায়। একদা সুক্ষ্ম, শিল্প সংস্কৃতির ধ্রুপদী পারম্পর্যে তথাকথিত সমাঝদাররা এখন বাজার ও লগ্নীমুগ্ধ সংস্কৃতির উপদেষ্টামণ্ডলী।

আজকের পৃথিবীতে সুস্থ, দেশজ প্রাণশক্তির ধ্রুপদী সংস্কৃতি কোথাও নিরাপদ নয়। তবে আশার কথা, সর্বত্র মানুষের হৃদয়ের অনেক গভীরে চেতন-অবচেতনের সঙ্গে মিশে আছে কালোত্তীর্ণ সংগীতের মহার্ঘ সম্পদ। থাকবে তার আভিজাত্য, প্রমত্ত গরিমা নিয়ে। আমরা নিশ্চিত, ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের সুমহান ঐহিত্যকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। পারবে না তার অফুরান প্রবল প্রাণশক্তির জন্য। আমাদের স্থির বিশ্বাস, কলকাতা এখনও ধ্রুপদী শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান।

কোনও বিকল্প নয়। নিজস্ব শিকড়কে লালন করা, একইসঙ্গে তার সৃজনশীল বিকাশ আমাদের ব্রত। নিজস্ব সংস্কৃতি, দৈনন্দিন জীবনচর্চার অনুশীলনেই আমাদের পঁচাত্তর। আমাদের নবযৌবন।

আমাদের দায়বদ্ধতা চিরায়ত সংস্কৃতির প্রতি। সেকারণেই ‘ফেক নয়, ফোক’। এবং এখানে আমরা আপসহীন। এই বিশুদ্ধতা রক্ষার অভিযানই আমাদের মন্ত্র।

আমাদের দায়বদ্ধতা বিস্তৃত। শুধু বাংলা কেন, এই বিশ্বের যা কিছু সৃজনশীল, যা কিছু মৌলিক— তার প্রতিই আমরা দায়বদ্ধ। আমরা তাই ‘লালন থেকে লেননে’।

কোনও ফতোয়া নয়। আমরা চাই সংস্কৃতির সব রঙ। শত ফুল বিকশিত হোক। ডানা মেলুক সংস্কৃতির সব শাখা। মৌলিকত্ব রেখে আধুনিকতার সৃজন প্রয়োগ— আমাদের দর্শন।

আজ, এই আনন্দসন্ধ্যায়, আপনাদের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন। আপনরাই শক্তি। এই সাফল্য আপনাদের। আমাদের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের। কোনও ত্রুটি থাকলে, তা একান্ত আমাদের।

০৩-০৬-২০১৭